পাকিস্তানের কাছে পাওনা টাকাঃ আদায়ের হকিকত

পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়।

পাকিস্তানের সাথে সর্বাত্মক যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবার পর বাংলাদেশ-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েকটি বিষয় নিয়ে টানাপোড়েন শুরু হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল-

১। যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক ৯৩ হাজার পাকিস্তানী সৈনিক— পাকিস্তানের চেষ্টা ছিল এদের দ্রুত ফিরিয়ে নেওয়া, বাংলাদেশের চেষ্টা ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে এদের বিচার করা

২। পাকিস্তানে আটক ৪ লক্ষাধিক বাঙ্গালীকে ফিরিয়ে আনা

৩। বাংলাদেশে আটক পাকিস্তানীদের (বিহারী) ফিরিয়ে দেওয়া

৪। পাকিস্তানের স্বীকৃতি আদায়; যার ফলশ্রুতিতে চীন নিবৃত্ত হবে ও বাংলাদেশের জাতিসংঘ সদস্যপদ লাভ করা সম্ভব হবে এবং

৫। পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদ আদায় করা

আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র তার পূর্ববর্তী রাষ্ট্রের তহবিল এবং অস্থাবরসহ সব বিষয়ে সম্পত্তিতে হিস্যার অধিকারী (ভিয়েনা কনভেনশন, আর্টিকেল ২)। ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে জাপান সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের এ সম্পর্কে বলেন, “ভুট্টো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে বিলম্ব করছেন এ কারণে যে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তিনি বাংলাদেশকে সম্পদের অংশ দিতে বাধ্য হবেন। পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশের সব সম্পদ নষ্ট করে দিয়েছে। আমাদের কোন জাহাজ ও বিমান পর্যন্ত রেখে যায়নি। তাদের উচিত দ্রুত স্বীকৃতি ও আমাদের প্রাপ্য সম্পদ ফেরত দেওয়া। আমি আন্তর্জাতিক আইনে ন্যায়সংগত প্রাপ্য ছাড়া পাকিস্তানের কাছ থেকে আর কিছুই চাই না।”

কূটনৈতিক টানাপোড়েনের বাদবাকি বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দিতে বাংলাদেশ কিছুদিন এই বিষয়টি নিয়ে চুপ থাকে। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের স্বীকৃতি লাভের পর পাওনা আদায় নিয়ে বাংলাদেশ তৎপরতা শুরু করে। ১৯৭৪ সালের ৫ এপ্রিল দিল্লীতে পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশের ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকের দু’দিন আগে বাংলাদেশ সরকার নিয়ন্ত্রিত পত্রিকা “দৈনিক বাংলা” প্রাপ্য বিষয়ে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে তথ্য উপাত্ত দিয়ে বলা হয়- শুধু বৈদেশিক বাণিজ্য খাতে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা তখনকার মূল্যমানে ৫০০০ (পাঁচ হাজার) কোটি টাকা। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে সহায়তার জন্য ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আসে। ঢাকা স্টেট ব্যাংকে থাকা এই টাকা যুদ্ধের মধ্যে পাকিস্তান সরকার পুরোটাই স্টেট ব্যাংক অফ লাহোরে পাচার করে দেয়। মুক্তিযুদ্ধ শেষে পুনর্বাসন কার্যক্রমে জড়িত জাতিসংঘের UNROD এর হিসাবে যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ১.২ বিলিয়ন ডলার; বাংলাদেশের সরকারী হিসাবে ১২৪৯ (এক হাজার দুইশ ঊনপঞ্চাশ) কোটি টাকা।

দৈনিক বাংলায় প্রতিবেদন প্রকাশের প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানও তৎপর হয়ে উঠে। উর্দূ পত্রিকা “নওয়া-ই-ওয়াক্ত” ১৯৭৪ সালের ১৯ এপ্রিল এক প্রতিবেদনে দাবি করে, শুধু বিহারীদের বাংলাদেশে ৫৫০০ কোটি রুপি সম্পদ রয়েছে এবং বাংলাদেশের উচিত পাকিস্তানকে সেই অর্থ ফেরত দেওয়া। এই প্রতিবেদনের হিসাব থেকে বুঝতে কঠিন হয় না যে বাংলাদেশের ৫০০০ কোটি টাকার বিপরীতে ৫৫০০ কোটি রুপির পাল্টা দাবির উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের সম্পদ দাবির ভিত্তিকে দূর্বল করা।

ঐ বছরের জুন মাসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকে সামনে রেখে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন প্রাপ্য সম্পদের একটি দালিলিক হিসাব প্রস্তুত করে। এতে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে কোন খাতে বাংলাদেশের প্রাপ্য কতো তা উল্লেখ করা হয়। পাশাপাশি বাংলাদেশে পাকিস্তানীদের সম্পদের হিসাবও দেখানো হয়। একই সাথে অখন্ড পাকিস্তানের অংশ থাকাকালীন বৈদেশিক ঋণের কতটুকু বাংলাদেশের দায় তাও উল্লেখ করা হয়। এসময় দু’জন বিদেশী বিশেষজ্ঞ তাঁদের গবেষণায় দেখান, যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির আর্থিক হিসাব বাদ দিলেও পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা ৩৯৭৫ মিলিয়ন ডলার।

১৯৭৪ সালের জুনের শেষদিকে ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরকালে দুই দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার লক্ষ্যে যে খসড়া দলিল দেওয়া হয়, তাতে সম্পদ বণ্টনের বিষয়টি অন্তর্ভূক্ত ছিল। বৈঠকে বাংলাদেশ স্বর্ণ, বৈদেশিক মুদ্রা মজুতের ১১,০০০,০০০ ডলারসহ মোট ৪০০০ মিলিয়ন ডলার সম্পদ দাবি করে। বিপরীতে বাংলাদেশের কাছে পাকিস্তান ১০.৮৮ কোটি টাকা পাবে। সফরসঙ্গী ১০০ জনের মধ্যে কোনো অর্থ বিশেষজ্ঞ নেই দাবী করে ভুট্টো এই আলোচনা পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলেও বাংলাদেশের চাপে পাকিস্তান এ বিষয়ে শেষ পর্যন্ত একটি কমিটি গঠনে রাজি হয়। তবে পাকিস্তান এ কথাও জানিয়ে দেয় যে নীতিগতভাবে তারা এই প্রস্তাব গ্রহণে প্রস্তুত নয়।

ভুট্টো ঢাকঢোল পিটিয়ে ঢাকা এলেও সফরের ব্যর্থতার বিষয়টি আড়াল করতে দেশে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের দাবির সমালোচনায় মুখর হন। অন্যদিকে পাকিস্তান কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে পূর্বশর্ত হিসেবে সম্পদ বণ্টন ও অবাঙালি প্রত্যাবাসনের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়। দ্বিপক্ষীয়ভাবে সম্পদ বণ্টন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি না হওয়ায় বাংলাদেশ ইস্যুটির অনুকূলে আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের চেষ্টা চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে দেশে ফেরার পথে ১৯৭৪ সালের ৪ অক্টোবর লন্ডনে হিথরো বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে সম্পর্কের অগ্রগতি অমীমাংসিত সমস্যাবলির সমাধানের ওপর নির্ভরশীল। আমরা আমাদের সম্পদের ন্যায্য হিস্যা চাই। আমরা তো কারও কাছে ভিক্ষা চাচ্ছি না।”

১৯৭৫ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত জ্যামাইকার রাজধানী কিংসটনে কমনওয়েলথ সরকারপ্রধানদের বৈঠকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটির সমাধানে আলাদাভাবে উদ্যোগ নেওয়া হয় এবং এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের তেলমন্ত্রী ওতেইবা ১৮ জুন ঢাকা সফর শেষে পাকিস্তান সফর করেন। এরপর ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে জেদ্দায় ওআইসি সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সম্পদ বণ্টন-সংক্রান্ত ইস্যুটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা দেখা দেয় এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা ফিরেই বিমানবন্দরে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের এমন একটি ধারণাও দেন। বাংলাদেশ এ ব্যাপারে কূটনৈতিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে এবং কুয়েত, সৌদি আরব ও আরব আমিরাতের মধ্যে যে কোন একটি দেশের মধ্যস্থতা কামনা করে। ওআইসি সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয় যে সম্পদ বণ্টন ইস্যুতে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে আসন্ন জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে আবারও আলোচনা হবে।

কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর বাংলাদেশের পাওনা আদায়ের আন্তর্জাতিক উদ্যোগ থমকে যায়। উপরন্তু, ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাদেশ এক সরকারি ঘোষণায় রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে খুশি হয়, কারণ বাংলাদেশে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বড় অংশই ছিল তাদের মালিকানাধীন। এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ হওয়া সত্ত্বেও সরকার ১৯৭৮ সাল থেকে কিছু কিছু পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ দিতে থাকে। ১৯৭৯ সালের জুলাই মাসে সরকারের এক আদেশে পরিত্যক্ত সম্পদের মালিকানা বাংলাদেশের নাগরিক হওয়া সাপেক্ষে পরিত্যক্ত সম্পত্তির দাবি করে হাইকোর্টে রিট আবেদনের সুযোগ পান। বহু অবাঙালি মালিক এ সুযোগে ঢাকা এসে টাকার বিনিময়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব সার্টিফিকেট, নন অপশন সার্টিফিকেট ইত্যাদি বের করে নিজেরাই রিটের মাধ্যমে পরিত্যক্ত সম্পত্তির মালিক হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সম্পত্তি ফিরে পাওয়া অবাঙালি ব্যবসায়ীরা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা পাকিস্তান বা অন্যত্র পাচার করে। পাশাপাশি পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের মধ্যে বাংলাদেশ ১৯৭৮ সালের মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সমাপ্ত প্রকল্পের মোট ৫০৬.৭৬১ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১৩.৪৮৫ মিলিয়ন ডলারের দায় গ্রহণ করে।

কিন্তু পাকিস্তানের কাছে পাওনা ৪ বিলিয়ন ডলার আদায়ের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার একটি বিষয় হিসেবে থাকলেও শেষ পর্যন্ত এটি কোন কার্যকর উদ্যোগ হয়ে উঠেনি।

১৯৭৪ সালে যখন বাংলাদেশ তার প্রাপ্য ৪ বিলিয়ন দাবি করে তখন ডলারের দর ছিলো ৮ টাকা। বর্তমান দর ১২২টাকা। প্রতিবছর সুদের হার কমপক্ষে ৬% ধরলে ২০২৫ সালে পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা কতো টাকা? ঠান্ডা মাথায় হিসাব করুন তো!

তথ্যসূত্রঃ

======

১. পাকিস্তানের কাছে বাংলাদেশের পাওনা সম্পদঃ প্রামাণ্য মূল্যায়ন, আবু মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।

২. Just Faaland J.R. Parkinson, Bangladesh The Test Case of Development, London: C. Hurst and Company, 1976

৩. New York Times, 9 July 1974.

৪. বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক একটি অপ্রকাশিত হিসাব, মতিউর রহমান, সাপ্তাহিক সন্ধানী, মে ১৯৮৮ ঈদসংখ্যা