মেজর ডালিম। বেখাপ্পা বীর উত্তম
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসে ২০ এপ্রিল ১৯৭১
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙালি ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে ভারতে আসে ২০ এপ্রিল ১৯৭১ [১]। মুক্তিযুদ্ধে ডালিম যোগ দেয় জুন মাসের শেষ দিকে, তৎকালীন সিলেট জেলার দক্ষিণ-পূর্ব রণাঙ্গনে মেজর সিআর দত্তের অধীনে [২]। মাঝের দুই মাস কলকাতাতেই ছিল। কী করছিল ডালিম এসময়? কিছু ধারণা পাওয়া যাবে পরবর্তীতে।
১২ জুলাই অফিসিয়ালি ৪ নং সেক্টরের কুকিরতল সাব-সেক্টর গঠিত হলে সাব-সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব পায় এই ক্যাপ্টেন [৩]। এই অঞ্চলের প্রথম উল্লেখযোগ্য যুদ্ধ “লাঠিটিলা যুদ্ধ” সংগঠিত হয় ২০ জুন। ভারতীয় আর্টিলারীর সহায়তায় মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী পাকিস্তান আর্মির শক্তিশালী ঘাঁটিতে আক্রমণ করে। ১৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। এই যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন রব। শরিফুল হক ডালিমের কোন উল্লেখ পাওয়া যায়না। ধারণা করা সম্ভব, ডালিম ২০ জুনের পর এখানে যোগ দেয়।
তার যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায় ১৭ জুলাই দিলখুশা চা বাগান অভিযানে। দিলখুশা চা বাগানে পাকিস্তান আর্মির একটি কোম্পানী এবং রাজাকারদের একটি কোম্পানী ছিল। মুক্তিবাহিনীর দুই কোম্পানী যোদ্ধা নিয়ে কুকিরতল থেকে রওয়ানা দিয়ে ভোর চারটায় দিলখুশায় পৌঁছায় ক্যাপ্টেন ডালিম। এই অপারেশনেও ভারতীয়রা আর্টিলারী সহায়তা দেয়। ডালিম কয়েকটি গ্রুপে বিভক্ত করে আক্রমণ সাজায়। কিন্তু পরিকল্পনার ভুলের কারণে পাকিস্তানীদের লক্ষ্যে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে মুক্তিবাহিনীর গ্রুপগুলোর নিজেদের মধ্যেই গুলি বিনিময় শুরু করে। অভিযানের অধিনায়ক ডালিম অবস্থান ছেড়ে উঠে মুক্তিযোদ্ধাদের গালিগালাজ শুরু করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। কোন সফলতা ছাড়াই পিছু হঠতে হয়। এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ছয়জন শহীদ হন। আহত হন সতেরজন।
২০ জুলাই দিনের বেলা ক্যাপ্টেন ডালিম আবার দিলখুশা আক্রমণের চেষ্টা করে। নিজে একটি গাছে চড়ে পাকিস্তান আর্মির অবস্থান দেখার চেষ্টাকালে মর্টার আক্রমণ চালায় পাকিস্তানীরা। ডালিম গাছ থেকে পড়ে যায় এবং হাতে আঘাত পায়। মুক্তিযোদ্ধারা দ্বিতীয়বারের মতো দিলখুশা থেকে পিছু হটেন। এদিনের আহত ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম ও তিনদিন আগে আহত রুহেল আহমদ বাবুকে কলকাতায় পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য [৪]।
সেই যে গেল ডালিম, রণাঙ্গনে কিন্তু আর ফিরল না। তাহলে ডালিম কোথায়?
উত্তর পাওয়া যায় বরেণ্য কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী আর রাজনীতিবিদ মোনায়েম সরকারের আলাপচারিতায়। কলকাতায় ডাঃ গণির বিরাট বাড়িতে তখন কয়েকজন বাংলাদেশী পেয়িং গেস্ট। মোনায়েম সরকারসহ কেউ কেউ থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরে কর্মরত। রাতের খাবারের সময় বহুভাষাবিদ সৈয়দ মুজতবা আলী সোৎসাহে শুনান পৃথিবীর নানা ভাষার রেডিওতে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পরিবেশিত সংবাদ। একদিন তাঁর স্বভাবসুলভ রসিকতার বদলে ক্ষেপে গিয়ে বললেন- “তোমরা কি মুক্তিযোদ্ধা না চুক্তিযোদ্ধা হে?” হঠাৎ এই আচরণে বিব্রত সবাই। পরে সৈয়দ সাহেব শুনালেন আসল ঘটনা।
ডালিম তার বান্ধবী নিম্মিকে নিয়ে পার্ক ওয়াইন হাউসে গিয়েছিল। পার্ক স্ট্রিট ট্রাম ডিপোর উল্টোদিকে অবস্থিত ওয়াইন হাউসটি নির্ধারিত সময় শেষে তখন বন্ধ। কলাপসিবল গেইট লাগিয়ে কর্মচারীরা ক্যাশ মিলাচ্ছে। কিন্তু ডালিমের এক কথা- তাকে মদ দিতে হবে। কর্মচারীরা জানিয়েছে, কোনক্রমেই এখন দেওয়া হবেনা। ডালিম তুমুল হৈচৈ করতে লাগল। এক পর্যায়ে পাড়ার তরুণরা হাজির। ডালিমের মারমুখী আচরণ, নিম্মির অশোভন সাজপোষাক ক্ষিপ্ত করেছে স্থানীয়দের। ডালিম যখন কোন কথাই শুনতে রাজী হলো না, তারা কয়েক ঘা লাগিয়ে দিল। ঘুষি খেয়ে ডালিম রাস্তায় পড়ে গেল। এমনিতেই তার এক হাতে স্লিং ঝুলানো।
বর্ণনা শেষে স্বর কিছুটা নরম করলেন মুজতবা আলী। বললেন- “এই ঘটনায় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। ডালিমের আচরণে এখানকার মানুষের মনে বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে খারাপ ধারণা ছড়াবে- এটা ভাবতেই আমার রাগ হচ্ছে” [৫]।
নিম্মির বাবা রফিকুল ইসলাম চৌধুরী বৃটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর, পরে পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিসে যোগ দেন। ১৯৭০ সালে কলকাতায় পাকিস্তান দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সম্পর্কে আরেক বিখ্যাত আমলা আকবর আলি খানের চাচাতো বোনের স্বামী। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীর সাথে রফিক চৌধুরী (এবং অন্য সব কর্মকর্তা) পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তখনও ঢাকায় থাকা রফিক চৌধুরীর স্ত্রী এবং কন্যারা পরে আকবর আলী খানের কাছে ত্রিপুরায় আসেন এবং খান তাঁদেরকে কলকাতা পাঠান [৬]।
রণাঙ্গন থেকে কলকাতা ফিরে ডালিম পাগল হয়ে উঠে নিম্মিকে বিয়ে করতে। ডালিম এমনই ভিআইপি যে, যুদ্ধের ডামাডোলের মধ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদকেও এতে জড়িয়ে পড়তে হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত সচিব ফারুক আজিজ খান একদিন সকালে দপ্তরে গিয়ে দেখেন উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রীর চোখ অনিদ্রায় লাল। ফারুক আজিজ ভাবলেন- নিশ্চয় যুদ্ধে মারাত্মক খারাপ কিছু ঘটে গেছে, পাকিস্তানীদের এয়ার এটাকে মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি! ক্লান্ত প্রধানমন্ত্রী বললেন- “ক্যাপ্টেন ডালিম রফিক চৌধুরীর মেয়েকে বিয়ে করে ফেলছে পরিবারের অমতে। রফিক চৌধুরী আমার আত্মীয় হন। গত রাত পুরোটা আমার কেটেছে তাঁকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে রাজী করাতে। আমি কি যুদ্ধ চালাবো নাকি বিয়ের ঘটকালী করবো?” [৭]
এসবের মধ্যেই ১২ আগস্ট বাংলাদেশ সরকার ডালিমকে মেজর হিসাবে পদোন্নতি দেয়। যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের একজন কর্মকর্তা ডঃ সা’দত হোসাইন খেয়াল করেন- “রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিশেষ করে এমএনএ ও এমপিএ-দের সম্পর্কে ডালিমের চরম ঘৃণা এবং তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভাব। রণাঙ্গনের কোন কমাণ্ডের সাথে যুক্ত না থাকলেও সিনিয়র সেনাকর্মকর্তাদের সাথে তার নিবিড় যোগাযোগ” [৮]।
শুধু ডালিম একা নয়, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া সেনা কর্মকর্তাদের অনেকেরই এই মনোভাব ছিল। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১১ জুলাই থেকে কলকাতায় শুরু হওয়া সেক্টর কমাণ্ডারদের এক সপ্তাহের সম্মেলনে। যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় আরো গতিশীল করতে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার এই সম্মেলন আয়োজন করেছিল। মেজর জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে কমাণ্ডারদের কয়েকজন আলাদা ওয়ার কাউন্সিল গঠনের জোর দাবী তুলেন, রাজনৈতিক অভিভাবকত্ব ছাড়া তারাই যুদ্ধের নেতৃত্ব দিবেন। এই প্রস্তাবে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রধান সেনাপতি জেনারেল ওসমানী পদত্যাগের হুমকি দেন। শেষ পর্যন্ত মেজর খালেদ মোশাররফের তীব্র বিরোধীতায় এই প্রস্তাব ভেস্তে যায়। জিয়াউর রহমানদের এই চিন্তায় ডালিমের সংযুক্তিও অসম্ভব নয়।
অসামান্য বীরত্বে সম্মুখ যুদ্ধে প্রাণ হারানো বহু মুক্তিযোদ্ধার ভাগ্যে বীর উত্তম তো দূরের কথা, কোন স্বীকৃতিই জোটেনি। কিন্তু এক মাসের কম সময় রণাঙ্গনে থেকে দুটি বড় ধরনের পরাজয় ঘটানো, পরবর্তী ৫ মাস রণাঙ্গনে না ফিরে ব্যক্তিগত অভিলাষ মিটানো মেজর শরিফুল হক ডালিমকে কেনো বীর উত্তম খেতাবে ভুষিত করা হয়েছিলো?
এ প্রশ্নের উত্তরে হয়তো ইতিহাস নীরব থাকবে। এ নীরবতা হিরন্ময় নয়।
তথ্যসূত্রঃ
======
১। একাত্তরের বীরযোদ্ধা, খেতাব পাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা (দ্বিতীয় খন্ড)। প্রথমা প্রকাশন।
২। মুক্তিযুদ্ধের সামরিক অভিযান (দ্বিতীয় খন্ড)। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এশিয়া পাবলিকেশন।
৩। মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান এ এস এম সামছুল আরেফিন। সময় প্রকাশন।
৪। মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস সিলেট। কাজী সাজ্জাদ আলী জহির। বাংলা একাডেমী।
৫। আত্মজৈবনিক। মোনায়েম সরকার। ভাষাচিত্র।
৬। পুরানো সিএ দিনের কথা। আকবর আলি খান। প্রথমা প্রকাশন।
৭। Spring 1971। Farouk Aziz Khan। আগামী প্রকাশনী।
৮। মুক্তিযুদ্ধের দিন-দিনান্ত। সা’দত হুসাইন। মাওলা ব্রাদার্স।
